উপার্জন শব্দটার সন্ধি-বিচ্ছেদ করলে আমরা পাচ্ছি ‘উপ+অর্জন’। ইংরেজীতে যা ইনকাম (income)। ভাগ ভাগ
করে অর্থ সবসময় তো আর মেলে না। বাংলায় যেমন উপ শব্দটার অর্থ সহযোগী, সহকারী, কাছাকাছি, পাশাপাশি ইত্যাদি। ইংরেজীতে আলাদা ভাবে অর্থ করলে পাওয়া
যাচ্ছে in মানে মধ্যে বা ভেতরে, আর come মানে আসা।
যাহোক, উপার্জন যদি সহযোগী বা পাশাপাশি অর্জন হয়, তবে অর্জনটা কি? হ্যাঁ, আমার ও প্রশ্ন এটা। তবে আমি যে সমাধানটা পেয়েছি তা
জানাচ্ছি। কোন কিছু আশা করে বা লক্ষ্য করে কাজের মাধ্যমে এগিয়ে যেতে যেতে সেই
লক্ষ্য পূরণ হওয়াটাই হল অর্জন।
যার ইংরেজী হল achievement.
তারমানে, কোন লক্ষ্য নিয়ে কাজে নেমে লক্ষ্য পূরণ বা
সেই কাঙ্ক্ষিত অর্জন পাওয়া পর্যন্ত যা পাওয়া যায়, তা হল উপার্জন। এক্ষেত্রে
উপার্জনটা আমাদের লক্ষ্য হওয়া কোনভাবেই কাম্য নয়। ভালো কোনও উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য
নিয়ে কাজে লেগে পড়ুন, মন দিয়ে কাজ করুন, অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে যাবেন। মাঝ দিয়ে আপনার
উপার্জন তো আছেই।
উপার্জন করতে গিয়ে আমরা বরাবরই যে
ভূল করে থাকি তা হলঃ-
লক্ষ্যের ধার
ধারিনা। ভালো কিছু হব বা করব, এটার কথা
মাথায় না এনে শুধু উপার্জন দরকার ভেবে কাজ খোঁজা।
আসলে এটা আমাদের
সামাজিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারো লক্ষ্য কি হওয়া উচিৎ, তা তার মেধা, তার নিজের ইচ্ছায় হবে, নিজে লক্ষ্য নির্ধারণ করবে। সেই অনুযায়ী নিজেকে গড়ে
তুলবে, লেখাপড়া করবে। লক্ষ্য অর্জনে নিরলস কাজ করতে
করতে একদিন লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে। অভিভাবক বা সমাজ তাকে তার লক্ষ্যে পৌঁছতে সাহায্য
করবে। কিন্তু লক্ষ্য বেঁধে দেবেনা। আসলে কি তাই হয়? কস্মিন কালেও নয়। আমাদের অভিভাবকগণ নিজের
ইচ্ছেমত সন্তানের লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেন। কখনো ভেবে দেখেন না, তার সন্তানের মধ্যে কোন ধরণের প্রতিভা
লুকিয়ে রয়েছে।
কোনও
ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্রকে খুব আগ্রহের সাথে ডি সি ম্যাগনেটিক মোটরের
উন্নয়ন বা তৈরি সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। হতাশ হলাম। বলল, “ভাইয়া, জাস্ট তত্বগুলো পড়েছি, বাস্তব জিনিষের কিছুই বুঝিনি।” বললাম, “তাহলে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব, এখন কি করবে?” বলল, “দেখি, কোন চাকরী টাকরি...”
রইস
উদ্দিনকে বলেছিলাম লেখাপড়ার পাশাপাশি কিছু করতে। তার কথা হলো, টাকা ছাড়া কিছুই সম্ভব নয়। অনেক করে বুঝালাম, অনেক যুক্তি দেখালাম, উদ্যোগ থাকলে লক্ষ্য অর্জনে টাকা কোন বাঁধা
নয়। কিন্তু তার একই কথা, টাকা ছাড়া নাকি
দুনিয়ায় কোনোকিছুই সম্ভব নয়। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, লেখাপড়া শেষ করে কি করবে। বলেছিল, দেখি, একটা চাকরী বাকরি। গরীব মানুষ, এছাড়া আর কিই বা করার আছে।
আর যখন কটা কামারের উদ্ভাবনী দৃষ্টিভঙ্গি
দেখে রইসউদ্দীনের কথাটি বলেছিলাম, তখন সজোরে
মাথা নাড়িয়ে বলল, "কি হয়ে যাচ্ছে দিন দিন মানুষ গুলো। তাদের
লক্ষ্যই যদি এতোটুকু হয়, তাদের থেকে
দেশ কি আশা করবে!"
কামার, অথচ দৃষ্টিভঙ্গির জন্য সে আমার কাছে আর দশজনার মতো নয়, বিশেষ মানুষ হিসেবেই ধরা পড়েছে। তার কথা, বড় কিছুর স্বপ্ন দেখতে হবে। সেই লক্ষ্যে কাজ
করে এগিয়ে যেতে যেতে অবশ্যই একদিন লক্ষ্যভেদ হবেই। না হলেও কাছাকাছি তো হবে। তবে
স্বপ্ন ছোট হলে তো... বড় কিছুর আশা করাটাই ভূল।
দুঃখ হলো।
আশেপাশে এমনি হাজারো রইস উদ্দীন লেখাপড়া করছে শুধুমাত্র একটা চাকরীর আশায়। তারা
জানেনা, কি চাকরী করবে, কে দেবে চাকরী। আর কেনই বা দেবে। তাদের
লক্ষ্য কোনও মতো উপার্জন। কোনকিছু অর্জন করার কথা তারা ভাবেও না। এরা উপার্জন করতে
গিয়ে ন্যায়-নীতির তোয়াক্কা করে না। আর এভাবেই সমাজ, তথা দেশ দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে।
দেশে বিদেশে হাজারো
উপার্জনওয়ালাদের দেখেছি। তারা কিছু পয়সার জন্য দেশকে (দেশের মান সম্মানকে) বেচে
দিতে মোটেও দ্বিধা করে না। নচিকেতার সেই গানের মতো, কিছু পয়সা পেলে তারা বাপকেও দেবে বেচে। তারা বলে, লজ্জা/সম্মান নাকি তারা এয়ারপোর্টে রেখে
গেছে। বিদেশে আবার লজ্জা কিসের! দেশে ফেরার সময় আবার এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে ফিরবে।
দেশের মানুষ চায়ও তাই। তারা অর্থ দেখে। কিভাবে কামাচ্ছে তা কখনো দেখে না।
এটাই কি
মানুষের জীবন হওয়া উচিৎ?
কখনই নয়। আমি যাই
করিনা কেন, একটা উদ্দ্যেশ্য
থাকতে হবে। মানুষ হয়ে জন্মেছি। কোনমতো এদিক সেদিক করে জীবনটা কাটিয়ে দিলেই কি হলো!
তাহলে তো সক্রেটিসকে চিনতাম না। আলেকজান্ডারকে জানতাম না। সম্রাট বাবর, আকবর, মাওলানা ভাসানী, শের ই বাংলা এ কে ফজলুল হক। হাজারো নয়, লাখো নয়, অগণিত মানুষের নাম আছে সারা দুনিয়ার ইতিহাসের পাতায়।
আমাদের মতো ভাবলে তাঁরাও কিন্তু হারিয়ে যেতেন কালের গর্ভে।
যাহোক।
উপার্জন নিয়ে কথা বলতে এত কথা। হ্যাঁ। আয় উপার্জন করা লাগে। নাহলে সংসার তো চলবে
না। তবে আপনি যাই করুন না কেন, আপনার
কর্মের সাথে সততা, নিষ্ঠতা, নিজের সবথেকে ভালোটুকু দুনিয়াকে দিন। সেও
আপনাকে মনে রাখবে। দারোয়ান, তবে খুব ভালো
দারোয়ান। গাড়িচালক, তবে খুব ভালো
গাড়িচালক। ব্যবসায়ী, খুব ভালো ব্যবসায়ী।
ডাক্তার হয়েছেন। ভালো, আপনার উপার্জন
কিন্তু কম নয়। কিন্তু তারপরও কেন মরা রোগীকে নিয়ে ব্যবসা করবেন! কত দরকার আপনার?!? সর্দীই তো লেগেছে। তাহলে সাতটা চেকআপ কেনো!?! আবার সেই নচিকেতার কথা মনে পড়ে গেলো। ‘হাসপাতালের বেডে, টিবি রোগীর সাথে, খেলা করে শুয়োরের বাচ্চা।’
আমি যা
বলতে চাইছি তাহলো, ভালো পথে রোজগার
করুন। ন্যায় পথে নীতির সাথে রোজগার করুন। অসৎ পন্থা কখনোই অবলম্বন করবেন না। কারণ, অসৎ পথে অর্থ আসবে ঠিকই, তাকে উপার্জন বলা যাবেনা। আর অর্জন, সেতো অনেক দূরের কথা।
উকীল, পুলিস, শিক্ষক, যাই হোন না
কেন। উদ্দেশ্য রাখুন ভালো কিছু করার। পৃথীবি আপনাকে মনে রাখবে। ভয় নেই। আপনার
উপার্জন বন্ধ হবে না। সাথে পেয়ে যাবেন বিরাট এক অর্জন।